একটি বিকেল আর দু’পিস পারুটি
যৌক্তিক সূত্রমতে সস্তা হাতঘড়ি সল্পায়ু হয়, তবে পৌনে চার বছর আগে কেনা এই ঘাটের মড়া কি করে এখনো টিকে আছে তা একমাত্র অদৃষ্টই ভালো জানেন, আমার জানা নেই। অমর্ষ পাষণ্ডটা যে শুধু বেঁচেই আছে তাইনা, একে পুরোদস্তুর সুস্থ্য আর কর্মক্ষম ও বলা যায়। যদিও ভরা যৌবনের চকচকে রূপ লাবণ্য হারিয়ে সে এখন ভীষণ রকম বিবর্ণ, মলিন।
ঘোলাটে কাঁচের নিচে বেলা তিনটে তেপ্পান্ন; দুপুর গড়িয়ে বিকেলের নিয়ম অবহেলা করে সূর্যদেব যেন শহুরে ঠিকানা ঠিক অপলক নয়নে নিরীক্ষণে ব্যস্ত। তৃষ্ণার শুকনো ঢেকুরে হৃদপিণ্ডের দাপাদাপি চরমে গেলেও সময়টা আমার কেমন যেন থমকে গেছে। স্লো মোশন হয়েছে নাগরিক কাকের ডানা, মিহি ধুলোয় পথশিশুর হুটোপুটি আর অখ্যাত ব্র্যান্ডের সেলস্ম্যানের পোশাকি চঞ্চলতা।
হাঁটতে হাঁটতে আনমনে ব্যাস্ত সড়কের কিছুটা ভেতরে ঢুকে পড়ায়, উচ্চস্বরে গালাগাল দিতে দিতে অদুর বাঁকে মিলিয়ে গেল দ্রুতগামী মিনিপিকাপ ড্রাইভার। হয়তো ওর মনেও না বলা কোন ভীষণ অপ্রাপ্তির ক্ষোভ জমে আছে, অপ্রস্তুত সুযোগে তাই একটু হালকা হবার অবচেতন প্রচেস্টা। এদিকে অধিক প্রাণশক্তির আশায় পরিপাকতন্ত্র যে নির্যাতন অবেলার নাস্তাটুকুর উপর করেছে তাতে তার অস্ত্বিত্ব এখন অতীত নয় বরং মিথ্যেই হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে শ্রান্ত শরীরে টলতে টলতে এগিয়ে চলেছি গন্তব্যহীনের মতো। বুকের বা’পাশে একটা চিনচিনে যন্ত্রনা আর ডান পায়ের কনিষ্ঠায় (নতুন স্যান্ডেলের কারনে) অনাগত ফোস্কার জ্বালা ছাড়া আর তেমন কোন কষ্ট নেই। তবু অবাধ্য চোখজোড়া ভিজে আসছে থেকে থকেই, খুব সংগোপনে আর কোন এক অপার্থিব মমতায়।
কিছুক্ষণ আগেও আমার সম্বল ছিলো সাকুল্যে সতেরো টাকা, যার মধ্যে ছিলো বিনিময়যোগ্য একটি দুই অংকের বৃহত্তর নোট, একটি দু’টাকার রুপোলী কয়েন আর শতবার এনাটমি এক্সপেরিএন্সড্ জীর্ণ পাঁচ। জরুরী প্রয়োজন জানানোতে পরিচিত থেকে মাত্রই মোবাইল ব্যাঙ্কিং একাউন্টে ফেরত পেলাম বহূদিনের পাওনার এক দশমাংশ, এক হাজার টাকা। এখন চাইলেই অন্তত পেটপুরে খাওয়া যায়, ছায়ায় একটু বিশ্রাম করা যায়। ক্ষুধা আর পড়ন্ত দাবদাহে মাথা বোঁ বোঁ করলেও লালকাপড়ে মোড়া বিরিয়ানীর হাড়ি, ঝলসানো চিকেনগ্রীল আর থাই-চাইনিজ ফার্স্টফুড গুলো কেমন অখাদ্যই মনে হচ্ছে।
ফুটপাথের একপাশে শুকনো ড্রেন অন্যপাসে আধ মিনিট সামনে খুপড়ি টং দোকান। জোড়াতালি দেয়া নড়বড়ে বেঞ্চের দুই পাশে বসে খোলা গলায় গল্পরত দুই প্রান্তিক শ্রমিক। অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ছেলেটির চোখে নির্ভাব চাঞ্চল্য। ঝুলন্ত পা দুটো দোলাচ্ছে আর ধীরলয়-অনুক্রমে হাতের আঙুলের গিট গুলো পটপট শব্দে ফোটাচ্ছে। রোদেপোড়া তামাটে ছাওনির মেদহীন সেই কঠোর কিন্তু সরল মুখে নেই কোন শংকা, নেই কোন অপ্রাপ্তির হতাসা প্রসূত ছাইচাপা ক্ষোভের রেখা। ভাবলেশহীন এমন নির্ভার মুখবিবরে যে অপার্থিব সুখের বহিঃপ্রকাশ তা দেবতার ও হিংসের কারন হবে নিশ্চিত।
অভিজ্ঞজনের হাতে অনুজ্জ্বল স্টিকার মোড়া পাতলা টিন কিংবা প্লাস্টিকের ছোট্ট কৌটোর মত। সে বসেছে এক পা ঝুলিয়ে, অন্য পা ভাজ করে বেঞ্চেই ওঠানো। পরনের রংচটা পিরানে গোটা তিনেক উজ্জ্বল রংরিপুর কাজ, ঝটিকা বাতাসে পিরানের চঞ্চলতায় ভেতরের প্রায় অস্থিসার কাঠামো স্পষ্ট। বাঁহাতে ধরা কৌটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাতে ডান তর্জনী দিয়ে মৃদু টোকা দিচ্ছে থেকে থেকে। ধারনা হয় তাতে আছে ছোট দানা অথবা মিহি গুড়ো অর্থাৎ পাউডার জাতীয় কিছু।
ক্লান্ত পথচারীর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ধীরে পা টেনে টেনে চলা। হয়তো সেটা খেয়াল করেই তারা জলের মতো সহজ হিসেবটুকু করে নিলো। পাসে গিয়ে দাড়াতেই জাফর অর্থাৎ সদ্য কৈশোর পেরিয়ে নব যৌবনে আমন্ত্রিত ছেলেটি জ্যেষ্ঠর দিকে দেড়হাত মত সরে গিয়ে যায়গা করে দিলো। আধাপাকা চুলের বয়ঃজ্যেষ্ঠই আতিথেয় আলাপ শুরু করতে মিনমিনে সুরে বললো, “স্যার বসেন। অনেক গরম তাইনা? যে রোইদ উঠছে…”। বহুদূর হাঁটায় ব্যাথায় পা দুটো এক প্রকার অসাড় হয়ে আসছিলো। বসতে বসতে শুধু বললাম “হুম”। ছোটলোকদের সাথে বেশী কথা বলতে নেই, সামাজিক শিক্ষার তো একটা গুরুত্ব আছে, তাইনা? যদিও আমি স্যারের মত দেখতে নই, পোশাক পরিপাটি হলেও সাধারন; তবুও স্যার যখন বলেই ফেলেছে দুরত্ব তো একটা রাখতেই হয়। তাই সাহেবী ঢঙে সোজা হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে বসলাম। সবকিছু ছাপিয়ে আমার হৃদয়ের ভেতরের হাহাকার কিন্তু চলছেই।
জাফর দোকানীকে হাক ডেকে বললো, “ও মালেক বাই হইলো? হেই উন্নিশশো কুয়াত্তর হাল থেইক্কা বয়া আছি।” বুঝলাম দোকানীর নাম ‘মালেক মিয়া’।
মিয়া?
মালেক যেহেতু চা-পান-বিড়ির টং দোকান চালায় আর পরনেও সেন্ড্যোগেঞ্জি-লুঙ্গী তাই তার নামের সাথে মিয়াটাই ভালো যায়। এই পোশাকে মালেক সাহেব বা মিস্টার মালেক বিস্তর বেমানান, রীতিমত হাস্যকর। বোটার ডগায় একটু চুন তুলে “হ হ এই ল” বলে ভাজ করা পানের খিলিটা এগিয়ে ধরলো ফুরফুরে মেজাজের মালেক মিয়া। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “একটা সিগারেট”।
কোন বাছবিচার ছাড়াই পানটা টপ করে মুখে পুরে ঘষঘষ করে চিবোতে লাগলো জাফর। কয়েক মুহুর্ত পর পর সজত্নে সতর্ক জিভে কিঞ্চিৎ চুন ঘষে নেয় বাঁ’হাতে ধরে রাখা পানের বোটা থেকে। ছোট্ট কৌটো থেকে ডান হাতের মধ্যমায় গাড় গেরুয়া রঙের পাউডার মত কিছু তুলে বাঁ’হাতে নিজের ঠোঁট টেনে দাঁতের গোঁড়ায় পুরে দেয় বয়স্ক জন। আমার অবাক চাহনির আকাঙ্ক্ষা মেটাতে আসুবিধা সত্বেও ঠোট-দাঁত-জিভ সথাসম্ভব কম নেড়ে অস্পস্ট স্বরে বলে, “গুল; দ্যাশ গ্যেরামত অনেক খাইতো… অহন আর হগ্গল দোকানত হাওন যায়না।”
মালেক মিয়া তাকে রাখা সিগারেট প্যাকেটের সম্ভারে হাত রেখে নরম সুরে ইতস্তত প্রশ্ন করে, “ব্যেন্সন?”। আমার শান্ত উত্তর, “লাইট; গোল্ডলিফ লাইটস”।
বহূদুর হেঁটে তৃষ্ণায় বুকের ভেতরটা একেবারে কাঠ হয়ে ছিলো, তাই সিগারেট জ্বালানোর আগে গলায় কিছুটা জল না ঢাললেই নয়। শত জনের কমন গ্লাসটা দেখে খুব একটা রুচি না হলেও আপাতত ব্যাতিক্রম কোন পথ নেই। অগত্য নাম সর্বস্ব ওয়াটার ফিল্টার থেকে গ্লাস পুরে যেইনা ঠোঁটে দেবো ওমনি আবারো সেই গুলপোরা মুখের অস্পস্ট স্বর, এবারে কিছুটা ব্যস্ত, “স্যার স্যার বইসা খান, ফানিডা বইস্যা খান। বড় হুজুরেত্থে আমি নিজে হুঞ্ছি, খাড়ায়া ফানি খাওন হাদিসে মানা। হ্যেছাড়া অনেক তিয়াসে হডাৎ তারতারি ফানি খাইলে হিক্কাও উঠথারে।” ওর পরোপকারী মনের প্রতি কেমন একটা শ্রদ্ধা এলো যা উপেক্ষার শক্তি আমার ছিলো না। জোড়াতালি বেঞ্চের সেই আগের যায়গাতেই সহজে বসে পড়লাম। সভ্যরা অল্প অল্প করে সময় নিয়ে পান করে। কিন্তু তা করতে আমার একেবারেই ইচ্ছে হলো না, তৃষ্ণার টানে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাস একবারে শেষ করলাম।
দুই তৃতীয়াংশ সিগার শেষ হওয়া পর্যন্ত মালেক মিয়ার চায়ের কাপ, চামচ, কেটলি ধোয়া আর দোকানের মালামাল সাজানোর খুটখাট শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ হলো না। নিস্তব্দতা ভেঙে বয়স্ক জন বললেন, “এক্ষান বনরুডি দেও মালেক, ঘরে যাই। তোমার চাচীর শরীলডা ভালা না গতর গরম হইসে। বিয়ানে খাজুর গুড়ের লগে মুড়ি দিসিলাম, খাইতারে নাই।”
মালেক রুটি আর সাথে ৩টা ট্যাব্লেট বড়ি দিয়ে বলল, “এই নেও গত হপ্তায় আমার ছুডো মাইয়ার জ্বর হইসিলো সাইরা গেছে। একপাতা বড়ির ৩ডা বাইচা গেছিলো, ভরা প্যাডে ১টা কৈরা খাওয়াইবা। আল্লা মালিক, ইন্সাল্লা ভালা হয়া যাইবো।”
চাচামিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলে আরে নাহ্, রাখ, আবার তগো কারো তবিয়াত খারাপ হইলে তখন লাগবো না?
শুনে মালেকের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলে, “অহন তরি ২৪১ ট্যাকা বাকি হইসে, কবে দিবা? দোকানত নতুন মাল তুলতে হইবো…”
মালেক কষ্ট পেয়েছে বুঝে চাচা লজ্জ্বিত হলো, উঠে পড়লো ভাঙ্গা বেঞ্চ থেকে। এখন সে পারুটি আর প্যারাসিটামল হাতে ঘরে ফিরবে।
এদিকে আমার শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। সিগারেটের শেষ টান দিতে প্রস্তুত হচ্ছি। জাফর একটু দূরে কিছুটা পানের পিক ফেলে বলে উঠলো, “একটু খাঁড়াও চাচা, আইতাছি।” চাচাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে পাখির চঞ্চলতায় তার সুঠাম দেহ নিয়ে অতিদ্রুত হেঁটে রাস্তার মোড় পেরিয়ে গেল।
সিগার শেষ করে ফিল্টার মাটিতে ফেলে স্যান্ডেলের সোলের তলায় পিষ্ঠ করে নিভিয়ে ফেললাম। এক অদ্ভুত করনে এই কাজটা করতে আমার একটু অস্বস্তি হয়। অগ্নি হচ্ছেন দেবতা, তাকে পায়ের তলায় পিষে…। ছিঃ ছিঃ!
মুহূর্তেই কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। নাহ্, পা কি আমাদের কম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ? কোন কারনে পা অকেজো হলে বোঝা যায় পায়ের কি মূল্য। সংস্কারের ভূল অপরাধবোধ কর্পূর হয়ে যায়।
এর মধ্যেই জাফর দৌড়ে ফিরে আসে কিঞ্চিৎ হাফাতে হাফাতে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর একটা তরতাজা বাতাবীলেবু হাতে। মুরুব্বী চাচার দিকে তুলে ধরে বলে, “লও চাচা, নুন-মরিচ দিয়া ভালা কৈরা ভর্তা করবা। মুখে টেস ফিরা আইবো। আমগো মায় মাখায়া দিতো জ্বর আইলে। এক দিনেই সাইরা যাইতো, পরের দিনই ইশকুল মাডে কিরকেট পিডাইতাম”। বলতে বলতে কেমন যেন ম্লান হয়ে আসে জাফরের চক্চকে চোখ, সুঠাম শরীরে একটা অদৃশ্য অবসাদ যেন ভর করে। ওর যা বয়স তাতে খুব বেশী পুরোনো অতীত নয়, তবুও অবাধ্য আবেগের কাছে হয়তো হেরে যায় ও।
“যাই, রাইতে ডাই-মিলে মাল আনলোডের ফুল ডিউটি আছে” ,বলে হন্হন্ হেঁটে প্রস্থান করে জাফর।
রাতে কাজ, তো পড়ন্ত দুপুরে এখনি এত ব্যাস্ত হবার কি আছে? দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জল আড়াল করতেই পালালো সে, বুঝতে বাকি থাকেনা কারো। আবার কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ নীরবতা। “মা’র কথা মনে ফড়ছে ফোলাডার”, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে মালেক মিয়া।
অভিজ্ঞতার বছর গড়িয়ে ত্রয়োদশ মাসে এসে, সেই বৃদ্ধ ঘড়িতে আজ আবারো বিকেল হলো। তবে এখন ঘাম চপচপে গরম নেই। আকাশে গাঢ় ধূসর মেঘ, কোথাও কোথাও তা আরো ভারী হয়ে ছোপ-ছোপ কালচে। পায়ের চটিজোড়া বেশ ক্ষয়ে গেলেও কিছুদিন ধরে তা অনেক কোমল মানে দারুন নরম। পায়ের সাথে তার চমৎকার বোঝপড়া হয়েছে নিশ্চই। কিন্তু মুচির সার্জিক্যাল জোড়াতালিও যে তাদের সুমধুর সম্পর্কটা আর দু’এক মাসের বেশী টেকাতে পারবেনা, এই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎবাণী করতে একাডেমিক কিংবা প্র্যাক্টিক্যাল কোন বিদ্যেই লাগে না।
ভাবনার ঘোর কাটাতে কনুইয়ের ডানপাশ ঘেঁষে (গ্লসি মেরুন রঙের) খুব সুন্দর একটা নিশান প্রাইভেটকার হুশ করে ছুটে গেল। তবে, বেশীদুর যাওয়ার আগেই প্রকৃতি যেন তার আভিজাত্যে একটু বাধ সাধলো। না, তেমন বড় কোন বিপত্তি নয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের করা কাছাকাছি দু’টো গতিরোধক বা স্পীডব্রেকারের আপত্তিতে ২-৪ সেকেন্ডের জন্য গাড়ির গতিটা একটু কমে গেল, এই যা। আগে থেকেই লেফ্ট সাইডের ডোর-গ্লাস সামান্য খোলা ছিলো, এই সুযোগে সেটা আরো কয়েক ইঞ্চি নেমে গেল। স্বরস্বতীর বীণা পাকড়াও করা হাতের মতো সুন্দর কমনীয় একটা সুঢৌল বা’হাত, হালকা ওজনের কিছু একটা বাইরে (পথে) ছুড়ে ফেললো।
তৎক্ষণাৎ আমার পেছন থেকে ছুটে গেল পাগল সদৃশ এক শীর্ণ মানুষ, অবশ্য সন্ধ্যের দিকে মানে আরেকটু পরে আলোছায়ার লুকোচুরিতে একে মানুষ না বলে ভূত বললে অধিকতর যুৎসই হবে। কেন এর ভূত হওয়া উচিৎ বা হলে ভালো হয় তা কয়েক লাইন বাদেই লিখছি…। ও যেমন আমার পেছন দিক থেকে সামনের দিকে ছুটে গেল, ঐ ছুঁড়ে ফেলা প্যাকেট পানে অদুর সামনের দিক থেকেও দৌড়ে এলো আরেক জন। টার্গেট অব্জেক্ট এক এবং আগ্রহে দু’জন সমান হলেও প্রকৃতির ইচ্ছের খেয়ালে ২য় জনের কোন হাত নেই। হয়তো ব্যালেন্স করার জন্য ঈশ্বর তাকে এক জোড়া এক্সট্রা পা আর একটা লেজ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা হিবেসে নির্ভূল। হাতের বদলে সমান সংখ্যক পা নাহয় মানা গেল, বাড়তি দেয়া লেজটা নির্ঘাত তাঁর হিসেবের ভুল অথবা একচোখা পক্ষপাতিত্ব।
হ্যেল্ল্যাগাইতো আম্গো ভিত্রের কেউ একজন বা কয়েকজন মিল্ল্যা কুত্তাডার ল্যাঞ্জা কাইট্টা শুধরায়া সমান করছে। কথা হইলো আমরা কি করুম না করুম সেইডা পরে; উপ্রে-নিচে আলোয়-আন্ধারে সুযোগ যেহানে আছে, ভুল আমরা কাউরেই করতে দিমু না।
এরই মধ্যে গাড়ি ১ম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ২য় অর্থাৎ শেষ বাধা উপেক্ষা করতে যাচ্ছে। আর ততক্ষণে (সম্পূর্ণ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিসীমা অল্প হওয়ার) একই লক্ষ্যে ভিন্ন দিক থেকে ছুটন্ত রেসার দুজনও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। তাদের আগ্রহের কেন্দ্র (কালো পিচঢালা পরিচ্ছন্ন পথে সদ্য ছুড়ে ফেলা সাদা প্যাকেটটা), যেন দিগন্ত পাথারে গর্বিত দ্বীপের আলোকিত মুকুট। গাড়ির কাচ কালো, তাই বাইরে বিকেল হলেও আমার মতো অনাহুত পর্যবেক্ষকের চোখে গাড়ির ভেতরটায় গভীর রাতের আধার। প্রাইভেসি আর অভিজাত ভাব উন্নয়ন + সংরক্ষণের জন্যে এটা হয়তো জরুরী। তবে নতুন গাড়ির ইঞ্জিন অনেক সভ্য হয়, মনিবের পরিবারের জন্য বিরক্তিকর শোরগোল করা জান্তব চেচামেচি সে নিজ অন্তরে চেপে রাখাতে পারে। তাই প্রায় কোলাহল শূন্য বাস্তবে (নব আবিষ্কারোত্তর) উত্তেজনা প্রসূত ব্যগ্র প্রশ্নটা শুনতে অসুবিধে হলোনা, “Ghost! Mama is he ghost?” শিশু কন্ঠের প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া গেল না। গাড়ি শেষ বাধাটা পেরিয়ে পুনরায় গতি সঞ্চারে নিমগ্ন হলো।
বুভুক্ষুটা শীর্ণকায় হলেও করুনাময় আল্লাহর মনুষ্যজাত সন্তান, সঠিক গ্রন্থানুসারে শ্রেষ্ঠ জীব। তাই হয়তো লেজকাটা পথের কুকুরটার আচরণে (অর্জিত প্যাকেটের একচ্ছত্র অধিকার আদায়ে) বিদ্রোহের আগ্রহ দেখা গেল না। ফলশ্রুতিতে ভুতই প্যাকেট কুড়িয়ে নিয়ে আরেকটু বা’পাসে সরে সল্পোচ্চ ফুটপাতের ধারের উপর বসলো। সাগ্রহে মোড়কের ব্যবচ্ছেদ পূর্বক অন্তঃসার উদ্ধারে মনোনিবেশ করলো। একান্ত অনুগতের ভাবাবেসে কুকুরও তার হাটুর পাশে চঞ্চল কিন্তু অপেক্ষারত। মোড়ক থেকে কিছু একটা টেনে বের করে ভুত। সাদা বর্ণের বর্গাকার স্লাইসাকৃতির যা বেরিয়ে এলো তা করুনাময় ঈশ্বর আগে থেকেই সমান দু’টুকরোয় ভাগ করে পাঠিয়েছেন! প্রথম পিসটি বা’হাতে নিজের মুখে তুলে অসভ্য কামড়ে ছিঁড়ে চিবোতে শুরু করে ভুত, দ্বিতীয়টা ডান হাতে এগিয়ে ধরে লেজচ্যুত শ্রীহীন চতুস্পদ পানে।
দুরে শিশুকন্ঠে ক্ষুধার্ত আবেদন শোনা যায়, “Mama, I’m hungry!”. প্রতিউত্তরে নারীর সচেতন সতর্কবাণী “That’s morning bread, shouldn’t take that. We’ll have fresh ones in a while for you!”. একে একে আমার মনে ভেসে ওঠে বছর পুরোনো বয়োজ্যেষ্ঠ, জাফর, মালেক মিয়া সহ আরো অনেক কেয়ারিং মুখচ্ছবি। আমরা দায়িত্ব নিয়ে দেবতুল্য বাচ্চাদের মানুষ করে তুলি, বেশভূষায় ভুত আর ভগবান চেনাই…। চলতে চলতে বুকের বা’পাশে ভেতরে কিছুটা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে, খুব বুঝতে পারছি কিছুক্ষণ বাদেই সময়ের অতলে ফুরিয়ে যাবে, আরো একটি বিকেল আর দু’পিস পারুটি।
Photo: Graphy Co